শিক্ষকরা বললেন- ‘আমাদের বেতন স্কেল কম, আমরা বৈষম্যের শিকার’, তখন রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র এবং তাদের মুখপত্র বলল- ‘তোমরা অশান্তি করছো।’ তাঁরা যখন শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে বললেন- ‘আমরা ভবিষ্যৎ গড়ি’, রাষ্ট্র তখন তাদের আন্দোলনকে অবজ্ঞা করে বলল- ‘তোমরা ট্রাফিক জ্যাম বাড়াচ্ছো।’ আর তখন রাষ্ট্রের অতি যুক্তিবাদী বাহিনী- পুলিশ তাদের বোঝাতে এলো, লাঠির সূত্র কীভাবে কাজ করে। এই লাঠি এখন রাষ্ট্রের ভাষা, যুক্তি, ও চূড়ান্ত প্রমাণপত্র। এই আঘাত রাষ্ট্রীয়ভাবে এ বার্তাই দেয় যে, রাষ্ট্র ঠিক আছে, কারণ তার হাতে লাঠি আছে- আর প্রতিবাদী মানুষ ভুল! যে দেশে শিক্ষককে লাঠি মারা হয়, সে দেশ সভ্য শাসিত নয়। এটি একটি জাতির আত্ম-অবমাননার চূড়ান্ত প্রমাণপত্র।
শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নিয়ে দেশে দশকের পর দশক ধরে বৈষম্য বিরাজ করছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষায় স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের কথা বলা হলেও আমলাদের বিরোধিতায় তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। অধিকতর যোগ্য প্রাথমিক শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার দাবিকে পাশ কাটিয়ে প্রথমে ১২তম এবং পরে ১১তম গ্রেডের প্রস্তাব নিয়ে আসা হয়, যা শিক্ষকদের মধ্যে আরও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি বেতন গ্রেড বাড়ানোসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলনরত প্রাথমিক শিক্ষকদের পদযাত্রায় পুলিশি লাঠিচার্জ, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার প্রমাণ করে, রাষ্ট্রে ন্যায় ও যুক্তির স্থান দখল করেছে দমন-পীড়ন। লাঠির আঘাতে শতাধিক শিক্ষক আহত হয়েছেন, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য চরম লজ্জাজনক। এই আঘাত কেবল শিক্ষকদের শরীরে নয়, আঘাত হেনেছে শিক্ষার মর্যাদা ও জাতির বিবেকের উপর।
আমরা এমন এক জাতি, যারা শিক্ষকদের মার খেতে দেখেও চায়ের কাপে চুমুক দেই, নাটক দেখে হাসি, আর আত্মগ্লানির খবরটাকে ‘স্বাভাবিক’ মনে করি। আমরা অন্যায়ের প্রতি অভ্যস্ত, অপমানের প্রতি প্রশিক্ষিত। এই নীরবতা রাষ্ট্রকে আরও আগ্রাসী করে তুলেছে। ন্যায় ও বিবেক এখন বইয়ের মৃত অধ্যায়, যা শিশুরা শুধু পরীক্ষার জন্য মুখস্থ করে; কিন্তু রাষ্ট্র, পুলিশ, আমলা- কেউ জানে না এর মানে কী!
প্রাথমিক শিক্ষকেরা জাতিকে বর্ণমালা শেখান। যারা একদিন শিশুকে শেখাতেন- ‘লাঠি দিয়ে মানুষকে আঘাত করা খারাপ’- আজ তারা নিজেরাই প্রমাণ পেয়েছেন, তাদের হাতে পুলিশের লাঠির মাইরের দাগ। রাষ্ট্রের চোখে শিক্ষক মানে - চিন্তাহীন, নতজানু, মুখ বন্ধ পেশাজীবী। রাষ্ট্র চায় শিক্ষক থাকুক, কিন্তু চিন্তা না করুক; স্কুল চলুক, কিন্তু প্রশ্ন না উঠুক!
দেশে এখন এক লাখেরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুই কোটি শিশু, আর লক্ষ শিক্ষক। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে তারা সংখ্যা- প্রাণ নয়, মর্যাদা নয়। শিক্ষকরা শুধু বেতন চান না, তারা সম্মান চান। কিন্তু রাষ্ট্রের যেসব মাথা এই সম্মানের মাপজোক করে, তারা নিজেরাই মেরুদণ্ডহীন। তারা চায় ভিখারি জাতি, চিন্তাশূন্য জাতি, যেখানে মানুষ থাকবে, কিন্তু মানুষ হবে না।
আমরা গর্বিত, শিক্ষকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে শেখাচ্ছেন- কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়, যখন রাষ্ট্র চায় তুমি হাঁটু গেড়ে বসো। তখন এই লড়াই কেবল বেতনের জন্য নয়, মর্যাদার জন্যও। এ লড়াই কেবল শিক্ষক বনাম সরকার নয়- এটি মানুষ বনাম অন্যায় রাষ্ট্রের লড়াই। যে রাষ্ট্র তার শিক্ষককে অপমান করে, সে রাষ্ট্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়- ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে।
আমি শিক্ষকদের পাশে আছি- কারণ তাঁরা দাঁড়িয়েছেন নিজেদের ন্যায়ের পক্ষে। তাঁদের এই প্রতিবাদ শুধু দাবির নয়, এটি এক মহান শিক্ষাও। যে শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সাম্যের জন্য কণ্ঠ তোলা-ই মানবতার শ্রেষ্ঠ পাঠ।
সত্য সরকার
গণমাধ্যম ও উন্নয়নকর্মী