সংগীত শিক্ষা: সৌদি আরবের জাগরণ, আমাদের সাংস্কৃতিক পশ্চাৎগমন

মির্জা গালিব তার এক বিখ্যাত শের-এ বলেছেন— 

“বাচ্চে-এ-আতফাল হ্যায় দুনিয়া মেরে আগে, হোতা হ্যায় শব-ও-রোজ তামাশা মেরে আগে।”

অর্থ—এই পৃথিবী আমার কাছে শিশুদের খেলার মাঠের মতো; দিনরাত আমার চোখের সামনে কেবল এক অন্তহীন খেলা বা নাটক চলতে থাকে। সত্যিই তো—আমরা প্রতিদিন নানা ঘটনা, উত্থান-পতন, দ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তির ভেতর দিয়ে বেঁচে আছি, যেন এক অনন্ত নাটকের চরিত্র। কেউ আনন্দে, কেউ হতাশায় ভাসছে—তবু সবাই যেন দিকহারা পথিক, সিদ্ধান্তহীনতার চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে, ঠিক-ভুলের সীমারেখা বুঝে উঠতে পারছে না। গালিবের এই শের কেবল কবিতার পঙক্তি নয়, মানবজীবনের চিরন্তন বাস্তব প্রতিচ্ছবি।

এই অনন্ত নাটকের সাম্প্রতিক দৃশ্যে বাংলাদেশে যে ঘটনা ঘটে গেল, তা নিঃসন্দেহে চিন্তার কারণ। প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত দেশের বুদ্ধিজীবী মহল ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে—ধর্মীয় দল ও কট্টর রক্ষণশীল মহলের আপত্তির মুখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এমন একটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের হাজার বছরের লোকায়ত ও উদার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর সরাসরি আঘাত, যে ঐতিহ্য আমাদের জাতিসত্তার মূল ভিত্তি।

বিস্ময়করভাবে, ইসলামের পবিত্রতম স্থানগুলোর ধারক ও বিশ্বের অন্যতম রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরব ঠিক বিপরীত পথে হাঁটছে। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে দেশটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় সংগীত শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আধুনিক ও প্রগতিশীল সমাজ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে ইতিমধ্যে ৯ হাজারেরও বেশি সংগীত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে এবং আরও ১৭ হাজার নারী শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এই দুটি চিত্রকে পাশাপাশি রাখলে বাংলাদেশের অবস্থান নিঃসন্দেহে বৈপরীত্যপূর্ণ, হতাশাজনক ও আত্মঘাতী মনে হয়।

সৌদি আরবের এই পরিবর্তন নিছক বিনোদনমূলক নয়; এটি তাদের ‘ভিশন ২০৩০’-এর অংশ, যা একটি ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের কর্মসূচি। যুবরাজ সালমানের লক্ষ্য তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করে পর্যটন, শিল্প, বিনোদন এবং জ্ঞানভিত্তিক খাতে বৈচিত্র্য আনা। এই রূপান্তরের জন্য একটি আধুনিক, সৃজনশীল ও বিশ্বমানের মানবসম্পদ তৈরি করা অপরিহার্য—এবং তারা উপলব্ধি করেছে, শিশুদের মানসিক বিকাশ, সৃজনশীলতা ও আবেগিক বুদ্ধিমত্তা গঠনে সংগীত শিক্ষা একটি মৌলিক উপাদান।

যে দেশ একসময় ওয়াহাবি মতাদর্শের কারণে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় কঠোর নিষেধাজ্ঞার প্রতীক ছিল, সেই দেশই আজ শিক্ষাক্রমে সংগীতকে স্থান দিয়ে রক্ষণশীলতার প্রাচীর ভাঙছে। সৌদি আরব দেখিয়ে দিচ্ছে—ধর্মীয় মূল্যবোধ অক্ষুণ্ণ রেখেই একটি জাতি আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে এবং প্রগতিশীল হতে পারে। একইসঙ্গে এটি নারী ক্ষমতায়নেরও প্রতীক, কারণ বিপুল সংখ্যক নারী শিক্ষককে এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

এই জাগরণের বিপরীতে বাংলাদেশের পশ্চাৎগমন সত্যিই বেদনাদায়ক। স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল প্রেরণা ছিল সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষা ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ—সেই জাতির প্রাথমিক শিক্ষায় সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করা এক আত্মবিরোধী পদক্ষেপ। সরকার যদিও প্রকল্পগত ত্রুটি, শিক্ষকসংকট বা প্রশাসনিক জটিলতার অজুহাত দিচ্ছে, তবুও শিক্ষাবিদ ও নাগরিক সমাজ একে ধর্মীয়-রাজনৈতিক শক্তির কাছে নতজানু হওয়া বলেই দেখছেন।

গণঅভ্যুত্থানের পর যখন দেশের মানুষ প্রগতিশীল পরিবর্তনের প্রত্যাশায় ছিল, তখন এই সিদ্ধান্ত সেই আশাকে ম্লান করে দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে, আমাদের নীতিনির্ধারণে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিশুদের মানসিক বিকাশের গুরুত্বের চেয়ে সংকীর্ণ ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাবই অধিক প্রাধান্য পাচ্ছে।

বাংলাদেশের হাজার বছরের লোকায়ত সংস্কৃতি—যেখানে বাউল, জারি, সারি, মুর্শিদী গানে ধর্ম, মানবতা ও আধ্যাত্মিকতা একসূত্রে গাঁথা—সেই ঐতিহ্যকেই এখন বিতর্কিত করে তোলা হচ্ছে। লালন শাহ, হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের মতো মনীষীরা দেখিয়েছেন, সংগীত কেবল বিনোদন নয়; এটি আত্মিক সাধনা, মানবমুক্তির পথ। অথচ আজ সেই ঐতিহ্যকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

রাষ্ট্রের এই দুর্বল অবস্থান দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আদর্শিক বিভ্রান্তির প্রতিফলন। প্রগতিশীল চেতনার দুর্বলতা সমাজে এক ধরণের অসহিষ্ণুতা জন্ম দিয়েছে। মননশীলতা ও যুক্তিবাদের জায়গা দখল করছে অন্ধ বিশ্বাস ও গোঁড়ামি—যা একটি জাতির সার্বিক অগ্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা।

সংগীত শিক্ষার মতো মানবিক ও সর্বজনীন শিক্ষাকে ধর্মীয় অজুহাতে বাতিল করা কেবল শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নয়, এটি সমাজের গভীর অসহিষ্ণুতার প্রতিচ্ছবি। মানবিক শিক্ষা মানুষকে ভিন্ন মত, সংস্কৃতি ও জীবনবোধের প্রতি শ্রদ্ধা শেখায়। যখন সেটি রুদ্ধ করা হয়, তখন সহনশীলতার অভাব সমাজে আরও প্রকট হয়। ইতিহাস সাক্ষী, যে সমাজে শিল্পচর্চা সীমিত হয়েছে, সেখানে উগ্রবাদ বেড়েছে, ভিন্নমতের প্রতি আক্রমণ তীব্র হয়েছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বা ভিন্নমতের মানুষের ওপর বারবার আক্রমণের পেছনেও রয়েছে এই মানসিক কাঠিন্য। সৃজনশীল শিক্ষার অভাব শিশুদের মনকে সংবেদনশীল না করে অনমনীয় করে তোলে, যা ভবিষ্যতে সমাজে ঘৃণা, বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে উৎসাহিত করে। রাষ্ট্র যখন মানবিক শিক্ষাকে উপেক্ষা করে ধর্মীয় চাপকে প্রশ্রয় দেয়, তখন তা কট্টরপন্থাকে শক্তিশালী করে এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে।

রাষ্ট্রের শিক্ষানীতির প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত এমন একটি কাঠামো তৈরি করা, যা প্রতিটি শিশুর সামগ্রিক ও ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত করবে। শুধু পাঠ্যবই নয়—সংগীত, চারুকলা ও শারীরিক শিক্ষা শিশুর মানসিক ভারসাম্য, সামাজিক দক্ষতা ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে অপরিহার্য। এই বিষয়গুলো বাদ দিলে আমরা এমন এক প্রজন্ম তৈরি করব, যারা প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে এগোবে ঠিকই, কিন্তু মানবিকতা, সহনশীলতা ও সৌন্দর্যবোধে পিছিয়ে পড়বে।

সৌদি আরব যেখানে মানবিক শিক্ষা ও শিল্পচর্চাকে আধুনিকতার অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করছে, সেখানে আমাদের এই পশ্চাৎগমন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদ্বেগজনক।

আজ যখন সৌদি আরব নিজেকে উদার, আধুনিক ও প্রগতিশীল মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, তখন বাংলাদেশের এই আত্মবিরোধিতা কেবল হতাশাজনক নয়, আত্মঘাতীও বটে। আমাদের উচিত ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মান জানানো, কিন্তু তাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না করা। বরং এই দুইয়ের মধ্যে প্রগতিশীল ভারসাম্যই আমাদের পথপ্রদর্শক হওয়া উচিত।

এই ভারসাম্যই গড়ে তুলতে পারে এক মানবিক, সুস্থ ও প্রগতিশীল সমাজ। এখনই সময় সেই সুরে ফিরে যাওয়ার—যে সুর আমাদের আত্মার, আমাদের মানবতার। কারণ, সংগীত কেবল গলার সুর নয়; এটি মানুষের হৃদয়ের ভাষা। সেই সুরকে নীরব করে দেওয়া মানে আমাদের আত্মার কণ্ঠ রুদ্ধ করা।

 

লেখক: সত্য সরকার

গণমাধ্যম ও উন্নয়নকর্মী


  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাংবাদিককে তুলে নেওয়ার বিষয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

গণভোট নিয়ে কোনো আইন নেই: সিইসি

দিল্লিতে খলিলুর রহমান-অজিত দোভাল বৈঠক

কটন বাড দিয়ে কান পরিষ্কার ক্ষতিকর!

শিশুশিল্পী থেকে রণবীরের নায়িকা, কে এই সারা অর্জুন!

এটা তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা টেস্ট ম্যাচগুলোর একটি হবে

লিবিয়ায় ৩ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার পর সাগরে নিক্ষেপ

ডেঙ্গুতে আরও ৬ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৭৮৮

প্রচারণায় তারেক রহমানের ছবি ব্যবহারে এনসিপির আপত্তি

সঞ্জীব চৌধুরীর প্রয়াণ দিবস আজ

১০

পল্লবীতে যুবদল নেতা কিবরিয়া হত্যা: পাতা সোহেল ও সুজন গ্রেপ্তার

১১

শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচন নিশ্চিতে সেনাবাহিনীর সহায়তা প্রয়োজন: প্রধান উপদেষ্টা

১২