সলপ আর ঘোল যেন সমার্থক শব্দ। অথবা ঘোল আর সলপ যেন একই শব্দ। সলপ নাম মুখে এলেই আরেকটি শব্দ চলে আসে তা হলো ঘোল। অন্যদিকে ঘোল নামের সাথে জড়িয়ে আছে সলপ নামটি। অতুলনীয় স্বাদ দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য এবং তুমুল জনপ্রিয় একটি পানীয় খাবারের কারণেই মুলত উল্লাপাড়া উপজেলার একটি অঞ্চলের নাম এতোটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উল্লাপাড়াকে দেশের আনাচে-কানাচে পরিচিত করে তুলেছে এই সলপের ঘোল। উল্লাপাড়ার ঐতিহাসিক নিদর্শন, বিশিষ্ট ব্যক্তির্বগরে মতোই ইতিহাস ঐতিহ্য বহন করছে সলপের ঘোল। সুস্বাদু এই পানীয় খাবারটি সারাদেশের মানুষের কাছে অন্যতম একটি জনপ্রিয় খাবারে পরিনত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই ঘোলের কারণে একটি মৃত রেল স্টেশনে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ আসছেন। স্টেশনে ট্রেন না দাড়ালেও সলপ রেলস্টেশনের পরিচিত দেশজুড়ে। ঘোল কেন্দ্র করে এই অঞ্চল ব্যবসায়িক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠেছে, কর্মংস্থান হয়েছে অসংখ্য মানুষের। সলপ স্টেশন সলপ বাজারের চারদিকে ঘোলের দোকানের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে হরেক রকম মুখরোচক খাবারসহ শিশুদের খেলনা সামগ্রীর দোকান। ঘোল কিনতে আসা ক্রেতাদের ঘিরেই এই অঞ্চলটি অন্যরকম একটি ব্যবসায় সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিনত হয়েছে। সলপের ঘোল কেবল নামে নয়, স্বাদে ঘোলের সেরাদের সেরা। সলপের ঘোলকে বর্তমানে বাংলাদেশের ঘোলের রাজা হিসেবে অভিহিত করছেন অনেকেই।
যেভাবে তৈরি করা হয় সলপের ঘোল:
কাকডাকা ভোরে গ্রামের খামারি স্থানীয় হাট-বাজার ছাড়াও মোহনপুর ও পাশ্ববর্তী দুগ্ধ সমৃদ্ধ এলাকা শাহজাদপুর থেকে গরুর খাঁটি দুধ সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহিত দুধ একত্রে করে বড় বড় সসপেনে(পাতিল) লাকড়ির চুলায় ৭-৮ ঘন্টা ধরে ভালোভাবে জ্বাল দিতে হয়। এরপর ছোট ছোট বিভিন্ন পাত্রে ঘন দুধ ঢেলে ঠান্ডা করার জন্য পানির চৌবাচ্চায় রাতভর রেখে দেয়া হয়। পরদিন ভোর থেকে এসব পাত্রে পরিমাণ মতো পানি মিশিয়ে বাঁশের চড়কির রশির সাহায্যে বিশেষ কৌশলে টেনে ঘোরানো হয়। কখনো একা আবার কখনো দুপাশ থেকে দুজন মিলেও চড়কি ঘোরানো হয়। তবে এতে পরিশ্রম ও সময় বেশী লাগার কারণে বর্তমান সময়ে বড় স্টিলের ড্রাম আকৃতির বেøন্ডার মেশিন বৈদ্যতিক লাইনের মাধ্যমে ঘোরানো হয়। এতে সময় ও শ্রম সাশ্রয় হয় এবং অল্প সময়ে অধিক পরিমানে ঘোল তৈরি করা যায়। তবে আগের পদ্ধতিতেও অনেকে ঘোল তৈরি করেছেন। সাধারনত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এখন বাঁশের তৈরি চড়কির সাহায্যে ঘোল তৈরি করে হাট-বাজারে বিক্রি করেন। সলপের ঘোল ব্যবসায়ীরা আধুনিক পদ্ধতিতে ঘোল তৈরি করছেন কয়েকবছর বছর যাবত। একসময় সলপের ঘোল ব্যবসায়ীরা তাদের বাড়ি থেকে ঘোল তৈরি করে এনে সলপ রেল স্টেশনের পাশে ছোট্ট টোং দোকান তুলে বিক্রি করলেও বর্তমানে তারা স্টেশনের সামনে ঘোল ঘর বানিয়েছেন। এই ঘোল ঘরের সামনে ঘোল বিক্রি এবং পিছনে ঘোল তৈরি হয়। এখানে শুধু ঘোল নয় ঘোলের সাথে তৈরি হয় মাঠা, উন্নত মানের ঘি ও দই। দুধ জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করে রাখার পর তা জমে দইয়ের মতো হয়ে যায়, এর উপরের অংশ থেকে ঘি তৈরি করা হয়। এছাড়া ওই জমানো দুধ থেকেই দই তৈরি করা হয়।
সোমবার সকালে সলপ স্টেশনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনের সামনে সারিবদ্ধ ঘোল ঘর গুলোতে ক্রেতাদের আনাগোনা না থাকলেও ভোর বেলা থেকেই শুরু হয়েছে ঘোল তৈরির কারিগরদের কর্মযজ্ঞ। ঘোল ব্যবসায়ীরা তাদের নিজেদের লোক দিয়ে হাট-বাজার থেকে দুধ সংগ্রহ করে আনছে, স্থানীয় অনেকে আবার দোকানে এসে দুধ দিয়ে যাচ্ছেন। কারিগররা এসব দুধ দোকানের পিছনে সারিবদ্ধ ভাবে বসানো সসপেন গুলোতে ঢেলে দুধ একটা জ্বাল করছেন। প্রায় ৭-৮ ঘন্টা জ্বাল দেয়ার পর দুধ জমাট বাঁধছে। দুধ জমাট বাধার পর দুধ ছোট পাতিলে রেখে পানির চৌবাচ্চায় রেখে দিচ্ছেন। ঠান্ডা হওয়ার জন্য রেখে দেয়া হচ্ছে পরের দিনের জন্য। অপরদিকে আগের দিনের ঠান্ডা হওয়া দুধে পরিমাণ মতো পানি মিশিয়ে কারিগররা শুরু করছেন ঘোল তৈরির কাজ। সেখানেই বসানো আছে বিশাল আকৃতির স্টিলের ড্রাম দিয়ে বানানো ঘোল তৈরির মেশিন। তার মধ্যে দুধ চিনি এবং অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে বৈদ্যতিক মোটরের সাহায্যে ঘোরানো হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময় ঘোরানোর পর যখন দুধ পানি চিনি ও উপকরণ মিশ্রিত হচ্ছে তখন ওই মেশিনের নিচে লাগানো ট্যাপ দিয়ে প্লাষ্টিকের বড় বড় জারে ঘোল রাখা হচ্ছে। একই মেশিনে আলাদা ভাবে তৈরি করা হচ্ছে ঘোলের মতোই আরেক পানীয় সুস্বাদু খাবার মাঠা। মাঠার পরিচিতি ঘোলের মতো ততোটা না থাকলেও সলপের মাঠার কদরও কিন্তু কম নয়। মাঠা মুলত দুধ দিয়েই তৈরি করা হয়। মাঠা তৈরিতে পানি কম ব্যবহার করা হয়। ঘোলের তুলনায় মাঠা বেশী ঘনত্ব হয়ে থাকে। ঘোল ও মাঠা দুটো ভিন্ন স্বাদের খাবার। দামেও ঘোলের তুলনায় মাঠা কেজি প্রতি ১৫-২০ টাকা বেশীতে বিক্রি হয়। প্রতি কেজি মাঠা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা। আর ঘোল বিক্রি করছেন ৬০ টাকা কেজি। ঘোল মাঠা তৈরি শেষে এখানেই বোতল জাত করার ব্যবস্থা রয়েছে। ঘোল মাঠা বোতল জাত করার জন্য একদল শ্রমিক পাশে বসেই কাজ করছেন। তাদের কেউ বোতলের মুখ খুলে দিচ্ছে কেউ বোতলে ঘোল মাঠা তুলছে আবার কেউ মুখ লাগিয়ে রাখছেন। ঘোল মাঠা তৈরি ও বোতল জাতের পর ঠিক স্টেশনের সামনেই দোকানে বোতল সাজিয়ে রাখা হয়। বলা যায় এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। দুপুরের পর থেকে শুরু হয় ঘোল মাঠা বিক্রির কাজ। ব্যবসায়ীরা দোকানের সামনে স্বচ্ছ বোতলে ঘোল মাঠা সাজিয়ে রাখেন এছাড়া বড় বড় পাতিলেও ঘোল মাঠা রেখে বোতলে তুলে বিক্রি করা হচ্ছে। রেলস্টেশনের সামনে সব গুলো দোকানই একই সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো। দুপুরের পর থেকে ক্রেতাদের ভিড় বাড়তে থাকে দোকান গুলোতে ঘোল মাঠা কেনার পাশাপাশি ক্রেতাদের ঘি কিনতেও দেখা যায়। ক্রেতারা প্লাষ্টিকের বোতল নিয়ে দাড়িয়ে থাকেন। অনেকে আবার পাইকারী দরে ঘোল মাঠার অর্ডার দিয়ে রাখেন আগে থেকেই। পাইকারী ও খুচরা ক্রেতা উভয়েই লাইনে দাড়িয়ে ঘোল মাঠা ক্রয় করেন। মাঝে মধ্যে উৎপাদন কম হওয়ায় ক্রেতা চাহিদা না মেটায় ক্রেতাদের মধ্যে হট্টোগোলও দেখা যায়। প্রতিদিন এখানে দুইশ থেকে আড়াইশ মণ ঘোল মাঠা তৈরি হয়ে ক্রেতাদের কাছে পৌছে যাচ্ছে।
ঐতিহ্যবাহী ঘোলের সাথে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে চিড়া মুড়ি:
সলপ স্টেশনের প্লাটফর্মের সামনে সারিবদ্ধ দোকান গুলোতে দুপুরের পর থেকে পুরোদমে ঘোল মাঠা বিক্রি শুরু হয়। বিক্রেতারা বড় ওরং এর সাহায্যে সামনে রাখা পাতিলে ঘোল মাঠা নারাচারা করে তা বোতলে ঢালেন। ক্রেতারা দোকানের সামনে লাইনে দাড়িয়ে ঘোল কনিছনে। এটি সলপ রেলস্টেশনের নিত্যদিনের চিত্র। সলপের ঘোল মাঠার সাথে আরো কিছু মুখ রোচক খাবার আছে যা খাওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ সলপে আসেন। তা হলো ঘোল মাঠার সাথে চিড়া মুড়ি মুড়কি। সলপে ঘোল মাঠা খেতে আসা লোকজনের বসার সুব্যবস্থা করেছেন দোকানিরা। দোকানিরা দোকানের সামনে ছোট ছোট ঘর করে রেখেছেন যেখানে চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা আছে। সেখানে বসে তৃপ্তিসহকারে ঘোল মাঠা চিড়া মুড়ি মুড়কি খাচ্ছেন বিভিন্ন স্থান থেকে আগতরা। স্টিলের বাটিতে দোকানিরা ঘোল মাঠা চিড়া মুড়ি মুড়কি ক্রেতাদের সামনে পরিবেশন করছেন। প্রতি বাটির মুল্য নেয়া হচ্ছে ৪০ টাকা। সেখানে নানান বয়সী মানুষের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, ভ্রমণপিপাসুসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ এখানে ঘোল চিড়া মুড়ি খেতে আসেন। এখানে আসা দর্শনার্থীদের আপ্যায়নের কমতি রাখে না দোকানিরা। বলেকুচি থেকে সলপ স্টেশনে ঘোল খেতে আসা সামউিল নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমি অনেক দিন ধরে সলপের ঘোলের ইতিহাস শুনে আসছি। আজ এখানে এসেছি ঘোল খেতে। এখানে আসার পর শুনলাম ঘোলের সাথে চিরা মুড়ি মুড়কি খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। চিড়া মুড়ি মুড়কির সাথে ঘোল খেলাম। এতোদিন শুধু সলপের ঘোলের গল্প শুনেছি আজ খেয়ে দেখলাম সত্যি এখানকার ঘোল খুব সুস্বাদু। সারাদেশেই ঘোল তৈরি হয় তবে সলপের ঘোলের স্বাদ অন্যরকম। আমি এখানে ঘোল খাওয়ার পর বাড়ির জন্যও পাঁচ কেজি ঘোল কিনেছি।
সেখানেই কথা হয় টাঙ্গাইলের ভুঞাপুর থেকে ঘোল খেতে আসা নাইম, সোহেল, রুবেল, জামাল, রহমান নামে কয়েক কলেজ ছাত্রের সাথে। তারা বলেন, আমরা সলপের ঘোলের নাম শুনেছি এছাড়া ফেসবুকেও অনেককে এই ঘোলের সুনাম করতে দেখেছি। তাই আমরা এখানে সবাই মিলে ঘোল খেতে এসেছি। সলপের ঘোল ও মাঠা সত্যি খুবই সুস্বাদু। এই ঘোল অন্য এলাকার ঘোলের চেয়ে সেরা। তবে এখানে আসতে আমাদের অনেকটাই ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। যদি এই স্টেশনে ট্রেন থামতো তাহলে দুর-দুরান্ত থেকে আসা লোকজনের অনেক সুবিধা হতো।
ইতিহাস ঐতিহ্যে সলপের ঘোল:
সলপের ঘোলের সাথে জড়িয়ে আছে শত বছরের ঐতিহ্য। অনেক চরাই-উতরাই পেরিয়ে খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেছে এই পানীয় খাবার। এই ঘোলকে কেন্দ্র করে উপজেলার পরিচিতি বেড়েছে দেশজুড়ে। একটি এলাকাও ব্যবসায় সমৃদ্ধ হয়েছে। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯২০ সালের দিকে বিট্রিশ শাসনামলে উল্লাপাড়ার সলপ এলাকায় রেলওয়ে স্টেশন প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯২২ সালরে দকিে এই এলাকার সাদেক আলী নামে এক ব্যক্তি কাজের সন্ধানে রাজশাহী যান। সেখানে তিনি কাজ খুজতে খুজতে এক ঘোল ব্যবসায়ীর কাছে কাজ পান এবং সেখানেই কাজ করতে থাকেন। সেই ঘোল ব্যবসায়ীর থেকে তিনি ঘোল তৈরি শেখেন। পরর্বতীতে তিনি রাজশাহী থেকে উল্লাপাড়ার নিজ গ্রামে আসেন এবং নিজে ঘোল তৈরি করেন। সেই থেকে সাদেক আলীর হাত ধরে সলপের ঘোলের যাত্রা শুরু হয়। এরপর সাদেক আলী গ্রামের কৃষকদের থেকে অল্প অল্প দুধ কিনে তা বাড়িতে চুলায় জ্বাল দিয়ে ঘোল তৈরি করেন। সাদেক আলী প্রথম দিকে অল্প পরিমান ঘোল নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফেরি করে বিক্রি করতেন। তখন সাদেক আলী ধান চালের বিনিময়ে মানুষের কাছে ঘোল বিক্রি করতেন। একসময় সাদেক আলী স্টেশন কেন্দ্রিক ঘোল বিক্রি শুরু করেন। রেলস্টেশনে পাশে মাটির কলসি নিয়ে বসে ঘোল বিক্রি করতেন তিনি। তার ঘোল বিক্রি দেখে মাঝে মধ্যে স্টেশনে আসা যাত্রীরা তার থেকে ঘোল খাওয়া শুরু করেন। বিশেষ করে গরমের দিনে তৃষ্ণা মেটাতে স্টেশনের যাত্রীরা ঘোলের প্রতি বেশী ঝোঁকেন। আসা যাত্রী ছাড়াও সলপে আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে আসা লোকজন সাদেক আলীর থেকে ঘোল কিনে খেতেন এবং পরিবারের জন্য নিয়ে যেতেন। একসময় সাদেক আলী সাদেক আলী স্টেশনের সামেন একটি দোকান করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেখানে ছোট্ট একটি দোকান করে নিয়মিত ভাবে স্টেশনের সামনে ঘোল বিক্রি করতে শুরু করেন। স্টেশনে আসা যাত্রীদের কাছেও সাদেক আলীর ঘোলের পরিচিতি পেতে থাকে। স্টেশনের যাত্রীরা ছাড়াও অনেকে সাদেক আলীর ঘোল কিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন। এভাবে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সাদেক আলীর ঘোলের প্রশংসা। জমে উঠতে থাকে সাদেক আলীর ঘোল ব্যবসা এবং আস্তে আস্তে সাদেক আলীর ঘোল পরিনত হয় সলপের ঘোল নামে। দীর্ঘদিন ব্যবসার পর সাদেক আলী মৃত্যুবরণ করলেও তার ব্যবসার অবসান ঘটেনি। তার (চার) ছেলে ব্যবসার হাল ধরেছেন। সাদেক আলীর চার ছেলের মধ্যে তিনজন মারা যাওয়ার পর তার নাতি এবং নাতিদের সন্তানরাও ব্যবসার দেখাশোনা করছেন। ঘোল ব্যবসায়ী হিসেবে সাদেক আলী খানের নাতি আব্দুল মালেক খান জাতীয় পুরষ্কারও পেয়েছেন।
সাদেক আলীর ছেলেদের ব্যবসায় উন্নতি দেখে স্থানীয় অনেকেই এ তাদের থেকে ঘোল তৈরি শিখতে থাকেন এবং তারাও ব্যবসায় শুরু করেন। এভাবে সলপ এলাকা ঘোল এলাকা হিসেবে পরিচিত হয়ে যায়। সলপের ঘোলের ঐতিহ্য ধরে রাখতে ১৯৯০ সালে পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজজি সরকার প্রতিবছর বৈশাখ মাসে ঘোল উৎসবের উদ্যোগ নেন। প্রথমে কামারখন্দ উপজেলার ড.সালাম জাহানারা ডিগ্রি কলেজের উদ্যোগে এই উৎসব পালিত হতো। ১৯৯৮ সাল থেকে সিরাজগঞ্জ জেলা শহরের প্রভাতি সংঘের উদ্যোগে এ উৎসবটি পালিত হচ্ছে। উৎসব উপলক্ষে এদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ সলপ স্টেশন এলাকায় আসেন। দুর-দুরান্ত থেকে অনেক ব্যবসায়ীরা ঘোল, মাঠা ঘি ও দইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন রেল লাইনের পাশে। উৎসব ঘিরে এখানে জমজমাট গ্রামীন মেলাও বসে। এটি এখন প্রসিদ্ধ মেলায় পরিনত হয়েছে কয়েক দশক ধরে।
সাদেক আলীর ছেলে হাজী আব্দুল মান্নান খান বলেন, আমরা ছোট বেলা থেকে বাবার সাথে ঘোল তৈরির কাজ করতাম, বাবা আমাদের ঘোল তৈরি শিখিয়েছেন। বাবার ইচ্ছে ছিলো তার তৈরি ঘোল একদিন দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। আমরা বাবার স্বপ্ন পুরণ করতে চার ভাই একত্রে ঘোলের ব্যবসা শুরু করি। যখন আমাদের ঘোলের চাহিদা ও সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন আমরা চার ভাই আলাদা আলাদা ভাবে স্টেশনের সামনে ব্যবসা শুরু করি। চার ভাইয়ের মধ্যে শুধু আমি এখনো জীবিত আছি। আমার তিন ভাই মারা যাওয়ার পর তাদের ছেলেরা ব্যবসা করছেন। আমাদের দেখাদেখি আরো অনেকেই সলপে ঘোলের ব্যবসা করছেন। আমাদের এই ঘোল এখন উল্লাপাড়ার ঐতিহ্য হয়ে দাড়িয়েছে। ঘোলকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলটি অনেক উন্নত হয়েছে। ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়েছে অনেকেই। তবে এখন আমাদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। একসময় এই স্টেশনে কয়েকটি ট্রেন দাড়াতো। আমরা সেসব ট্রেনে সহজে ঘোল পরিবহণ করতে পারতাম। খুব সহজে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ঘোল পাঠানো যেতো। এমনকি সেসময় ট্রেনযোগে নিয়মিত ঘোল যেত সলপ থেকে। বেশ কয়েকবছর যাবত ট্রেন বন্ধ হওয়ায় এখন ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। মুলত একসময় ঘোলকে কেন্দ্র করে সলপে বেশী ট্রেন দাড়াতো তখন ঘোলের দাম কম থাকলেও আমাদের স্বর্ণযুগ ছিলো। এখন দেখা যাচ্ছে অনেকেই ঘোল খাওয়ার জন্য আসছে তাদের উল্লাপাড়া স্টেশনে নামতে হচ্ছে। সেখান থেকে নানা উপায়ে মানুষ এখানে আসছে এতে তাদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আমাদের আমাদের এই ব্যবসার আরো প্রসার ঘটাতে এই স্টেশনের কার্যক্রম আবার চালুর দাবী জানাই সরকারের প্রতি। ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে রাখতে এটি আমাদের প্রাণের দাবী তাদের।
এখন সাদেক আলীর বংশের ৩য় প্রজন্মরা পুরো দমে ব্যবসার হাল করছেন। তাদের সাথে সাদেক আলীর বংশের ৪র্থ প্রজন্মরাও ব্যবসার দেখভাল করছে। শতবছরের ইতিহাস ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন সাদেক আলী খানের নাতি আব্দুল মালকে, আব্দুল খালকে, নূর মোহাম্মাদ, আবুল কাশমে সহ ১৯ জন এই ব্যবসার সাথে জড়তি। খালকে খান ঘোল ঘরের স্বত্বাধিকারী আব্দুল খালকে খান জনকণ্ঠকে বলেন, তাদের ঘোল ও মাঠার ব্যবসা শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য নয়, সলপের এই ঘোলের সাথে মিশে আছে এই অঞ্চলের ঐতিহ্য। উল্লাপাড়ার ঐতিহ্যের স্মারক বহণ করছে তাদের এই ঘোল। সারাদেশের মানুষ সলপের ঘোলের নাম জানেন এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এখানে ঘোল খেতে আসেন। এই ঘোলের এমন খ্যাতি অর্জিত হয়েছে যা আসলে আমরা বলে বোঝাতে পারবো না। এক সময় সলপ স্টেশনে ট্রেন দাড়াতো না, পরে মাঝখানে এখানকার ঘোলকে কেন্দ্র করে কয়েকটা ট্রেন দাড়ানো শুরু হয়। এসব ট্রেনে সকালে এবং বিকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘোল পরিবহণ করা হতো। অনেক ব্যবসায়ী আমাদের কাছে অর্ডার দিলে আমরা ট্রেনে পৌছে দিতাম এছাড়াও সাধারন মানুষও সহজে ট্রেন যোগে সলপে আসতে পারতেন। তখন আরো জমজমাট থাকতো সলপ স্টেশন। কয়েক বছর যাবত নানা কারণে স্টেশনে কোন দাড়াচ্ছে না এতে আমাদের ঘোল পরিবহণে অনেকটাই সমস্যা হচ্ছে। সারাদেশের ব্যবসায়ীরা আমাদের থেকে ঘোল কিনে পরিবহণে সমস্যা পড়ছেন। এখানে ট্রেন না দাড়ালেও কিন্তু বিকেলে শুধু ঘোল খাওয়ার জন্য স্টেশন প্রাঙ্গন মানুষে সরগরম থাকে। আমরা দোকানের সামনে মানুষের বসার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করেছি সেখানে বসে মানুষ ঘোল খাচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় সলপের ঘোল বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবারের শেষে পরিবেশন করা হচ্ছে। মানুষের কাছে অন্যতম একটি পানীয় খাবার হিসেবে সলপের ঘোল খ্যাতি অর্জন করেছে। শুধু সাদেক আলী খানের বংশে ১৯ জন ঘোল ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন। সলপ পঞ্চক্রোশী আশপাশের সব বাজারে অসংখ্য ঘোলের দোকান হয়েছে। ধারনা মতে প্রতিদিন শুধু সলপ বাজার ও স্টেশন এলাকায় দুই’শ থেকে আড়াই’শ মণ ঘোল তৈরি হয়। ঘোল ছাড়াও আমরা উন্নতমানের ঘি ও দই তৈরি করি যা সারাদেশেই প্রশংসিত হয়েছে। আমরা আমাদের এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর।
তিনি আরো বলেন, মানুষ ঘোল খেয়ে প্রশংসা করেন এতে আমাদের খুবই ভালো লাগছে। আমরা উল্লাপাড়ার এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। ঘোল তৈরিতে আমরা নানান উপায় অবলম্বন করছি, আমরা দেশী গরুর খাঁটি দুধ সংগ্রহ করছি, কারণ দেশী গরুর দুধে ঘনত্ব বেশী এই দুধের তৈরি ঘোলের তুলনামুলক স্বাদ বেশী হয়ে থাকে। আমরা এতোটাই সতর্কতার সাথে ঘোল তৈরি করছি যেন কেউ আমাদের তৈরিকৃত ঘোলের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। সলপের ঘোলের সাথে এখন আর শুধু আমাদের পরিবারের সন্মান জড়িত না পুরো উপজেলার ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে ঘোলের সাথে। তাই আমাদের তৈরিকৃত ঘোলের মান খারাপ হলে পুরো উপজেলার সন্মান নষ্ট হবে। মানুষ আমাদের থেকে আস্থা হারাবে।
সাদেক আলী খানের নাতি জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ঘোল ব্যবসায়ী আব্দুল মালকে খান বলেন, আমাদের জন্মের পর থেকেই ঘোল তৈরি দেখে আসছি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই কাজের সাথে জড়িত আছি। একসময় আমাদের ঘোলের পরিচিতি এতোটা না থাকলেও, এখন উল্লাপাড়ার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জিনিষের নাম বললে সেখানে আপনাআপনি সলপের ঘোলের নাম বলতে হয়। অনেক ধৈর্য সততা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আমাদের এই সফলতা। তিলে তিলে আমরা সলপের ঘোলকে শতবছরের ঐতিহ্যে পরিনত করেছি। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের ঘোল তৈরি দেখার জন্য মানুষ আসছে। শুধু ঘোল খাওয়ার জন্য দুর-দুরান্ত থেকে মানুষ আমাদের কাছে আসে এটি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের বিষয়। বলা চলে সারাদেশের মানুষই আমাদের এই ঘোলের নাম জানেন। দাদার রেখে যাওয়া ব্যবসা আমরা এই অবস্থায় নিয়ে এসেছি এর পিছনে অনেক আবেগ শ্রম গøানি জড়িয়ে আছে। দিনে দিনে তিলে তিলে ঐতিহ্যবাহী সলপের ঘোলের জন্ম হয়েছে। আমাদের এই যাত্রায় আমরা ক্রেতাদের মতামতকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছি। ঘোলের মানের প্রতি আমাদের সর্বচ্চ নজরদারী থাকে। আমরা নিজেরা ঘোল পরিক্ষী-নিরীক্ষার পাশাপাশি ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তাদের দিয়ে ঘোল পরীক্ষা করেন। সলপের ঘোল কারিগরদের কারণেই মুলত আজ আমরা এই অবস্থায় আসতে পেরেছি। এখন সলপ স্টেশন এলাকা এবং সলপ বাজারে প্রায় একশোটিরও বেশী ঘোল ঘর হয়েছে। তারা সবাই সলপ ঘোল ঘর নামে ব্যবসা করছে। এই অঞ্চলের অনেক মানুষ ঘোল তৈরি বিক্রির কাজে নিয়োজিত হয়েছে। সলপ ছাড়াও উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায় সলপের নামে অনেকে ঘোল তৈরি ও বিক্রি করছেন। আমাদের এখান থেকে ঘোল পাইকারি দরে কিনে রাজধানী ঢাকা, বগুড়া রাজশাহী সহ বিভিন্ন স্থানে ঘোল বিক্রি করছেন অনেকে। আমরা বিদেশেও রপ্তানি করছি সলপের ঘোল। সলপের ঘোলকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বিকৃতির দাবী করছি। ইতিমধ্যে ঘোল বিক্রেতা হিসেবে আমি জাতীয় পদক পেয়েছি। আশা করছি সকলের সহযোগীতায় ভবিষতে আরো সুনাম অর্জন করবে ঐতিহ্যবাহী সলপের ঘোল।
তিনি ব্যবসায়কি স্মৃতচারণে বলেন, মাঝে এক সময় আমাদরে ঘোল ব্যবসায় অবনতি হলে ২০০৪ সালে আমি সিরাজগঞ্জ ডিসি অফিসে একটি চাকরির ভাইভা দিতে যাই। সেখানে তৎকালীন ডিসি আমিনুল ইসলাম আমাদের এই সলপরে ঘোলের ইতিহাস শুনে তিনি আমাকে চাকরি না করে ব্যবসা চালিয়ে যতেে বলেন। পরবর্তীতে আমি চাকুরির দিকে না ছুটে পুনরায় দাদার ব্যবসার হাল ধরি। ডিসি মহোদয়, সিরাজগঞ্জের প্রথম আলোর প্রয়াতঃ সাংবাদকি আমিনুল ইসলাম খোকন সহ জেলার অন্যান্য সাংবাদিকসহ সুধীজনদের পৃষ্ঠপোষকতায় আবারো পুরোদমে ব্যবসার হাল ধরি। এরপর থেকে আর থেকে আর আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমরা উল্লাপাড়ার এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতিবছর স্টেশন এলাকায় ঘোল উৎসব করে থাকি। সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষার্থীসহ ভ্রমণ পিপাসুরা এখানে আসেন শুধু মাত্র ঘোল খাওয়ার জন্য। ঘোল উৎসবের দিন আমরা ব্যবসায়ীরা আগতের বিনামূল্যে চিড়া মুড়ি ও মুড়কির সাথে ঘোল দিয়ে আপ্যায়ন করি।
সলপে ঘোল কিনতে আসা ক্রেতা, ভ্রমণপিয়াসু, ব্যবসায়ীসহ সর্বমহলের মানুষ ঐতিহ্যবাহী এই ঘোল ব্যবসায় আরো প্রসার ঘটাতে সলপ স্টেশনে ট্রেন থামানোর দাবী জানান। এতে যেমন ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘোল সরবরাহ করতে পারবে তেমনি সারাদেশের মানুষ ট্রেন যোগে সহজে এখানে এসে ঘোল কিনতে পারবেন। এছাড়া কৃষি পণ্য পরিবহণ ও নিত্যদিনের যাতায়াতেও অনেক দুর্ভোগ কমবে মানুষের।
সলপ থেকে ঘোল কিনে সাভাররে ব্যাংক টাউন এলাকার ব্যবসায়ীরা বলনে, আমরা নিয়মিত এখান থেকে ঘোল নিয়ে সাভারে বিক্রি করি। প্রায় দশ বছর যাবত আমি সলপের ঘোল বিক্রি করে আসছি। আমরা এখানে সলপের ঘোল নামে দোকান করে ঘোল বিক্রি করে আসছি। আমার দোকানেও আশপাশের লোকজন সলপের ঘোল খাওয়ার জন্য ভিড় জমায়। সলপের ঘোল স্বাদ ও মানের দিক থেকে অতুলনীয়। সাভাররে ব্যাংক টাউন ছাড়াও রেডিও কলোনি, ঢাকা মরিপুর, চট্টগ্রাম, ফেনি, নারায়নগঞ্জসহ দেশের বিভিন্নি স্থানরে পাইকাররা এখান থেকে নিয়মিত ঘোল কিনে বিক্রি করে।