শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার বই বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে। বইগুলো ছিল বাংলা একাডেমির সংগ্রহে। এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা রকম আলোচনা–সমালোচনা।
পুরোনো বই বিক্রির ফেসবুক পেজ ‘পুস্তক জোন’ গত ২২ সেপ্টেম্বর পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত জর্জ বার্নাড শ এর ‘প্লেস আনপ্লিজেন্ট’ বইটি বিক্রির পোস্ট দেয়। বইয়ের ভেতরে বাংলা একাডেমির সিল, পাশে লেখা– ‘জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত সংগ্রহ’। এই বিজ্ঞাপন দেখে খবর নিতে গিয়ে দেখা গেল জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা অন্তত ২০টি বাংলা ও ইংরেজি বই বাংলা একাডেমি থেকে বিক্রি হয়ে গেছে কেজি দরে।
বইগুলো বিক্রি করছে পুরোনো বই বিক্রি করার কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ ‘বিচিত্র বিচিত্র বই’ পেজের। যোগাযোগ করা হলে এই প্ল্যাটফর্ম পরিচালনাকারী মো. রাশেদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নীলক্ষেতসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় এক ট্রাক পুরোনো বই কিনেছেন। তার মধ্যে পান জাহানারা ইমামের স্বাক্ষর দেওয়া দুটি বাংলা ও পাঁচটি ইংরেজি বই।
জাহানারা ইমামের পরিবার তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহের যে বই দিয়েছিল বাংলা একাডেমিকে, সেগুলো বাংলা একাডেমির বিক্রি করে দেওয়ার সমালোচনা উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কেউ লিখেছেন, ‘বাংলা একাডেমির সংগ্রহের বই এখন ফুটপাতে।’ কেউবা লিখছেন, ‘এভাবে কি দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে না?’
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম অবশ্য বলছেন, ২০১৪ সালে গঠিত একটি কমিটি একাডেমির সংগ্রহশালায় একাধিক কপি থাকা এবং অসংরক্ষণযোগ্য কিছু বই বাতিল বলে নির্ধারণ করেছিল, সেগুলোই বিক্রি করা হয়েছে।
‘পাখির গান বনের ছায়া’, শহীদ আখন্দের লেখা বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী। সবুজ রঙের ভেতর কালো রেখাচিত্র দিয়ে আঁকা গাছ। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত বইটি লেখক নিজে স্বাক্ষর করে উপহার দিয়েছিলেন জাহানারা ইমামকে। ১৯৬৮ সালে জাহানারা ইমামের জন্মদিনে একজন তাঁকে মস্কোর প্রগতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটি উপহার দিয়েছিলেন। এসব বইয়ের কোনোটি ৬০০ টাকা, কোনোটি পাওয়া যাবে ৩৪০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে পুরোনো বই বিক্রির পেজগুলোতে।
তবে সব ছাপিয়ে গেছে শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ বইটি। ফেসবুকে পুরোনো বই বিক্রির প্ল্যাটফর্ম ‘বিচিত্র বিচিত্র বই’ এই বইয়ের জন্য দাম হেঁকেছে অন্তত এক লাখ টাকা। দাম না পেলে সংশপ্তকের এই সংখ্যাটি বিক্রি না করে ‘সিন্দুকে’ রেখে দেওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। বইটির বিশেষত্বের কারণ শহীদুল্লা কায়সার নিজে ১৯৬৭ সালের ৪ মার্চ জাহানারা ইমাম এবং তাঁর স্বামী শরীফ ইমামকে বইটি দিয়েছিলেন। ‘জনাব ইমাম ও জাহানারা ইমামকে শুভকামনার নিদর্শন হিসেবে লেখক’ লিখে নিচে স্বাক্ষরও করেন শহীদুল্লা কায়সার।
জাহানারা ইমাম, আহমদ শরীফ ও সিকান্দার আবু জাফরের ব্যক্তিগত সংগ্রহের বই তাঁদের মৃত্যুর পর বাংলা একাডেমিতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। জীবিতদের মধ্যে মহাদেব সাহা নিজের বইয়ের সংগ্রহ তুলে দেন নিজেই। এ ছাড়া রাজিয়া মজিদসহ আরও কয়েকজন বিশিষ্টজনের ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে বাংলা একাডেমির কাছে। আছে মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির বিশাল সংগ্রহ, যেখানে রয়েছে দুষ্প্রাপ্য বই। এই বইগুলো সংরক্ষণের দায়িত্ব একাডেমির গ্রন্থাগার বিভাগের।
প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহে থাকা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বই নীলক্ষেতে কীভাবে যাচ্ছে, জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারে যাঁরা বই জমা দিয়েছিলেন, তাঁদের বই থেকে ডুপ্লিকেট কপি, মানহীন বই বাছাইয়ের জন্য ২০১৪ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি বই বাছাই করে বাতিলযোগ্য বইগুলো নির্ধারণ করেছিল।